নিউক্লিয়ার চুল্লি (NUCLEAR REACTOR)কি?এটি কিভাবে শক্তি উৎপাদন করে?এর উপকারী ও অপকারী দিক কি? নিউক্লিয়ার চুল্লি নিয়ে বিস্তারিত......

পৃথিবীতে শক্তির চাহিদা সবসময়ই ছিল, আজীবন থাকবে ।কেননা ,শক্তি হলো সভ্যতার ধারক।যে সভ্যতা যত শক্তির চাহিদা মেটাতে পেরেছে ,তারা তত দ্রুত উন্নতি করেছে । কিন্তু এই শক্তি উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা প্রতিনিয়তই পৃথিবীর ক্ষতি করে যাচ্ছি।তাই বলে কি  মানুষ শক্তি উৎপাদন করবে না?হ্যা অবশ্যই।কিন্তু তা এমন এক পন্থায় যেটা পরিবেশের কম ক্ষতি করবে।আর পরিবেশের কম ক্ষতি করার প্রয়াস নিয়ে মানুষ
আবিষ্কার করছে নিউক্লিয়ার চুল্লি।তাহলে আসুন জেনে এই নিউক্লিয়ার চুল্লির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।


নিউক্লিয়ার চুল্লি কি??

নিউক্লিয়ার চুল্লি হলো এমন এক চুল্লি যেখানে শক্তি কয়লা,গ্যাস বা তেল ইত্যাদি ধরনের কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে  উৎপন্ন করা হয় না।এখানে শক্তি উৎপন্ন করা হয় পরমানুর নিউক্লিয়াসের ভেতরের শক্তি দিয়ে। পরমাণুর অভ্যন্তরে যদি দেখার চেষ্টা করা হয় ,তবে দেখা যায় যে পরমাণু চারদিকে ইলেক্ট্রন আর কেন্দ্রে ভারি নিউক্লিয়াস দ্বারা গঠিত ।আবার নিউক্লিয়াসের ভেতরে প্রোটন আর নিউট্রন থাকে ।পরমাণুর নিউক্লিয়াস মাত্রাতিরিক্ত ছোট (পরমাণুর তুলনায়),তবুও পরমানুর ভর বলতে আমরা এই নিউক্লিয়াসের ভরকেই বুঝি (কারন ইলেক্ট্রনের ভর অনেক অনেক কম)।এতো ছোট অবস্থানে প্রোটন আর নিউট্রন কনিকা আবদ্ধ করে রাখতে শক্তি  দরকার হয়।এ শক্তিকে বলা হয় বন্ধন শক্তি(Binding Energy)। এরা অনেকটা চাপা বলের মতো আবদ্ধ থাকে ।কোনোভাবে যদি আমরা বলটাকে ফাটিয়ে দিতে পারি ,তাহলে নিউক্লিয়াস নামক বলটি ফেটে যাবে আর নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে সজোরে নিউট্রন আর প্রোট্রন বাইরের দিকে আসতে থাকবে  এই ফাটিয়ে দেয়ার জন্যে বুলেট হিসেবে ব্যবহার করা হয়  একটি নির্দিষ্ট শক্তিসম্পন্ন নিউট্রন।এই নিউট্রন  দ্বারা কোনো তেজষ্কিয় মৌলকে খুব জোরে  আঘাত করা হয়। যার ফলে উক্ত মৌলটি ভেঙ্গে গিয়ে অসংখ্য নিউট্রন নির্গত করে ।এরা আবার বুলেট হিসেবে কাজ করে ।এবার পাশের মৌলগুলো ভাঙার জন্য নতুন করে শক্তি দিয়ে নিউট্রন আনার দরকার হয় না ।পূর্বের ভেঙ্গে যাওয়া মৌলটিই এবার বুলেটরুপী 'নিউট্রন" এর যোগান দেয় । এইভাবে একটি চেইন বিক্রিয়া শুরু হয় এবং বন্ধন শক্তি এর সমপরিমাণ শক্তি প্রতিবারে নির্গত হতে থাকে ।ফলে কয়েক মুহূর্তেই বিপুল শক্তি পাওয়া যায় । এই বিক্রিয়া যে জায়গায় বা যে চুল্লিতে ঘটানো হয় তাকে নিউক্লিয়ার চুল্লি বা নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর বলে।।




নিউক্লিয়ার চুল্লিতে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় শক্তি কিভাবে উৎপন্ন হয়??

নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর কিভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য উপরের চিত্রটি দেখুন ।
নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর এর ভেতর একটা STEAM GENERATOR থাকে,যেটা টার্বাইন কে ঘুরিয়ে বিদুৎ উৎপাদন করে।জেনারেটরের শক্তির যোগান দেবার জন্য
একটা বয়লার থাকে ,যার মধ্যে পানিকে উত্তপ্ত বাষ্পে পরিনত করা হয়।পানিকে উত্তপ্ত করার জন্য যে তাপের প্রয়োজন হয়,সেই তাপ সরাসরি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া
হতে প্রাপ্ত তাপশক্তি হতে আসে।নিউক্লিয়ার রিয়াক্টরের ভেতর যে তাপের সৃষ্টি হয়,তা পানি দ্বারা কমানো হয়।ফলে পানি উত্তপ্ত হয়।যদি কোনো কারনে এই উত্তাপ
সরিয়ে নিতে দেরি হয়ে যায় ,তাহলে কিছুক্ষনের মধ্যে রিয়াক্টরটি গলে যাবে ও কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে।

আবার পানি যে উত্তপ্ত হচ্ছে ,সেটাকে আবার ঠান্ডা করার প্রয়োজন হয় । যার জন্য  বিশাল কুলিং টাওয়ার বসানো হয়।

 চিত্রে রিয়াক্টরের ভেতরে যে রড দেখা যাচ্ছে ,সেটা খুব গুরুত্বপুর্ন।কেননা এই রডগুলো নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রন করে।বিক্রিয়ার সময় এই রডগুলো চুল্লির খুব ভেতরে ঢুকানো থাকে ।কিন্তু কোনোভাবে যদি এই রডগুলো বেড়িয়ে যায় তবে বিক্রিয়া তার নিয়ন্ত্রন
 হারাবেএবং বিস্ফোরন ঘটবে।

নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় প্রচুর নিউট্রন উৎপন্ন হয়।এই নিউট্রন সরানোর প্রয়োজন পড়ে।এজন্য চিত্রের রডগুলো ব্যবহার করা হয়। বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রঙ্কারী এই রডগুলো ক্যাডমিয়াম ধাতুর তৈরি।কারন ক্যাডমিয়াম ধাতু নিউট্রন শোষন করে ।মুলত নিউট্রনের পরিমান
 কমানোর জন্য এই রডগুলো ব্যবহার করা হয়।।



 নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার তাৎপর্য

 নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় এক টন ইউরেনিয়াম _২৩৫ এর বিক্রিয়া ঘটালে যে পরিমান শক্তি উত্তপন্ন হয় তা দশ লক্ষ টন কয়লা পুড়িয়ে যে শক্তি পাওয়া যায় তার সমান।সুতরাং কার্বন নির্গমন না করেই আমরা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার দ্বারা বিপুল পরিমান শক্তি পেতে পারি। কয়েকটি রিয়াক্টর দ্বারা পুরো দেশ চালানো সম্ভব হবে।



  নিউক্লিয়ার চুল্লির অসুবিধা
 
  এই বিক্রিয়ার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল এই বিক্রিয়ায় যে বর্জ্য তৈরি হয় তা প্রকৃতিতে মিশে যেতে প্রায় দশ হাজার বছর সময় লাগে।অবাক হবার কিছু নেই।তাছাড়া এই বর্জ্য মানব পরিবেশের আশেপাশে রাখলে তার তেজষ্ক্রিয়তা মানুষকে তা তিলে তিলে
  কষ্ট দিয়ে মারবে।এই বর্জ্যের আশেপাশে থাকা শিশুরা বিকলাংগ হয়ে যেতে পারে। এজন্য এই নিউক্লিয়ার  বর্জ্য মাটির অতি গভীরে অথবা যেসকল পাহাড় শিলা দ্বারা গঠিত ,যেগুলোতে অতি গভীর গর্ত করে সেগানে সিসা বা পুরু লোহার ড্রামে ভরে রাখা হয় যেকোনো প্রকার জীবের নাগালের বাইরে। এই বর্জ্য থেকে রেহাই পেতে অনেক ধরনের গবেষণা চলছে । এই বর্জ্য বিজ্ঞানীরা মহাশুন্যে নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা করেছেন।আবার অনেক বিজ্ঞানী বিশেষভাবে কাচ তৈরির গবেষনা করে যাচ্ছেন ,যেটার মধ্যে নিউক্লিয়ার বর্জ্য   রাখলে তা মানুষ ও পরিবেষের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

আবার এইসব চুল্লি চালাতে দক্ষ লোকবল ও উচুমানের সফটওয়্যার ,হার্ডওয়্যার দরকার হয় ।যেকোনো সময় অসাবধানতাবশত,প্রাকৃতিক দূর্যোগ,কারিগরি ত্রুটি ইত্যাদি কারণে ভয়াবহ বিপদ ঘটে যেতে পারে ।চেরনোবিল বিপর্যয় ,জাপানের সুনামিতে চুল্লি বিপর্যয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।



  আজ এটকুই।আবার আরেকদিন হয়তোবা নতুন কিছু নিয়ে হাজির হব। ততদিন সবাই ভালো থাকবেন ।
 আল্লাহ হাফেজ 


Comments